আচ্ছা যারা গবেষণা করেন তারা সমাজে কিভাবে অবদান রাখেন? অথবা আপনারা যারা গবেষণা করেন তাদের মধ্যে কি কেউ নিউটন, মেরি কুরি বা আইনস্টাইন হবেন নাকি তারা শুধুমাত্র বিদ্বান সেজে জনগণের করের টাকা নষ্ট করছেন? বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, বাস-ট্রেনে পরিচিত হওয়া সহযাত্রী কিংবা উচ্চমাধ্যমিক পাশ করা সপ্ন-এঁটো কিশোর প্রায়শই এমন প্রশ্ন করে থাকেন। সত্যি বলতে আমার নিজের কাছে এখনও এই ধরণের প্রশ্ন খুবই গুরুত্যপূর্ণ বলে মনে হয়।
আমি তখন সদ্য পি.এইচ.ডি ছাত্র হিসেবে কাজ শুরু করেছি। মহাবিশ্বে যখন প্রথম তারা আর গ্যালাক্সি সৃষ্টি হয়েছিল তখন তারা ধীরে ধীরে আশেপাশের নিস্তড়িৎ মাধ্যমকে আয়নিত করে। এই পুরো প্রক্রিয়াটি ঠিক কখন হয়েছিল বা কিভাবে হয়েছিল এই সম্পর্কে আমাদের এখনও অনেককিছু অজানা। আমার কাজ ছিল আমরা ভবিষ্যতের কিছু বিশেষ টেলিস্কোপ ব্যবহার করে এই বিষয়ে আর কি কি নতুন তথ্য জানতে পারি তা নিয়ে গবেষণা করা। প্রথমে আমাকে বলা হলো একটি বিশেষ গবেষণাপত্র পড়ার জন্য আর তারপর ওই গবেষণাপত্রের সবগুলো ফলাফল আমাকে নতুন করে পুনরায় নিজের হাতে নির্ণয় করতে (রিপ্রোডিউস) বলা হলো। পুরো গবেষণাপত্রটি আট-দশ বার পড়ার পর মনে হলো আমি দশ শতাংশেরও কম বুঝেছি। এমন সময় আত্মবিশ্বাস বলে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। মনে মনে তখন এইসব প্রশ্ন ঘোরা ফেরা করছে। নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করছি সত্যি তো মহাবিশ্বে কেন আর কিভাবে কয়েকশো লক্ষ বছর আগে তারা আর গ্যালাক্সি তৈরী হয়েছিল তা জেনে আমাদের কি হবে।
একদিন তাই নিজের সংশয় কাটানোর জন্য আমার পি.এইচ.ডি উপদেষ্টা অধ্যাপক ডেভিড স্পার্গেলের কাছে এই প্রশ্ন করে বসলাম। উনি তখন প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার সাথে সাথে নিউ ইয়র্কে একটা নতুন প্রতিষ্ঠানের (সেন্টার ফর কম্পিউটেশনাল অস্ট্রোফিজিক্স বা সি.সি.এ.) অধিকর্তা হিসাবে কাজ করছেন। আমরা বসে আছি একটা কফিশপে যার নাম খুব অদ্ভুত- “স্মল ওয়ার্ল্ড কফিশপ”। উনি তার সহজাত ভঙ্গিতে বললেন যে আসলে গবেষণায় আমাদের অবদান খানিকটা ইউরোপের বৃহৎ গির্জা তৈরী করার মতো। মিলান শহরের বিখ্যাত ক্যাথিড্রাল (ডুওমো দি মিলানো) সম্পূর্ণ করতে প্রায় পাঁচশো বছরেরও (১৩৮৭ -১৯৬৫) বেশি সময় লেগেছে। যিনি প্রথম পরিকল্পনাটির নকশা করেছিলেন তিনি কিন্তু ক্যাথিড্রালটি সম্পূর্ণ অবস্থায় দেখে যেতে পারেননি। আবার যিনি কাজ সম্পূর্ণ হওয়ার পর কাথিড্রালটির মাথায় রাজা নেপোলিয়ানের মূর্তি প্রতিস্থাপন করেছিলেন তিনি কিন্তু ক্যাথিড্রাল তৈরী হওয়ার পুরো পক্রিয়াটি দেখে যেতে পারেননি। বাস্তুকার, চিত্রশিল্পী, রাজমিস্ত্রি, ভাস্কর্যবিদ দিনের পর দিন কঠোর পরিশ্রম করেছেন যার ফলে এত সুন্দর একটা সৃষ্টিকার্য্য মিলান শহরের উপর দাঁড়িয়ে আছে আর তাই তার সামনে দাঁড়িয়ে আমরা নিজচিত্র তুলে মনে মনে বলে উঠি, “মানবজাতির তৈরী করা এ এক অপূর্ব সৃষ্টি!”আমাদের মধ্যে কেউ কেউ পরমাণুর মধ্যে মৌলিক কণাগুলোর আচার আচরণ নিয়ে গবেষণা করে ওই গির্জার একটি ছোট্ট জানালা তৈরী করছেন, আবার তাদের মধ্যে অনেকেই কয়েক কোটি আলোকবর্ষ দূরের এক কৃষ্ণ গহ্বরের ছবি তুলে এবং তা নিয়ে গবেষণা করে ওই গির্জার দেয়ালে অপরূপ তৈলচিত্র আঁকছেন, আবার আর এক দল মহাবিশ্বের জন্ম, আকার আর তার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা করে ঐ গির্জাটির কাঠামো তৈরী করছেন।
আমাদের মধ্যে সবাই আইনস্টাইন বা মেরি কুরী না হলেও আমাদের সবার প্রচেষ্টায় তৈরী করা ওই গির্জাটি মানবজাতির ইতিহাসে অপূর্ব স্থাপত্য হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকবে।আমাদের দেশে কয়েক কয়েক লক্ষ ছেলেমেয়ে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন গবেষক হওয়ার সপ্ন দেখে। তারাও ভবিষ্যতে গবেষণার মাধ্যমে এমন অনেক অনেক স্থাপত্য তৈরী করবে যা মানবজাতির ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। শুধু মাঝে মাঝে সংশয় হয় একটা দেশ তাদের সঠিকভাবে স্বপ্ন দেখার অনুপ্ররণা দিচ্ছে তো?
২০১৬ সালে আমার তোলা মিলান শহরের সেই ক্যাথেড্রালের ছবি।
